গর্ভবতী মায়েদের সুস্থ সন্তান জন্মদানের পরামর্শ
প্রতিটি মা-ই চায় তার সন্তান সুস্থ এবং সবল হয়ে জন্ম নিক। গর্ভাবস্থা একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়, যখন একজন মায়ের জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস এবং মানসিক অবস্থা সরাসরি ভ্রূণের বিকাশকে প্রভাবিত করে।
পোস্ট সুচিপত্রঃসুতরাং, গর্ভবতী মায়েদের সুস্থ সন্তান জন্মদানের পরামর্শ মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। একটি সুস্থ গর্ভাবস্থা এবং সুষম শিশুর জন্ম নিশ্চিত করতে মায়েদের অনেক বিষয়ে সচেতন হতে হয়। এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব কিভাবে একজন গর্ভবতী মা সুস্থভাবে তার সন্তানের জন্ম দিতে পারেন এবং কি কি বিষয়ে তার মনোযোগী হওয়া উচিত। আমরা জানব পুষ্টিকর খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম, চিকিৎসকের পরামর্শ, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে যা একটি সুস্থ গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্মদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
প্রতিটি মা এবং তার সন্তানের জীবন অত্যন্ত মূল্যবান, তাই সঠিক তথ্য এবং পরামর্শ মেনে চলা উচিত যাতে মা এবং শিশু উভয়েই সুস্থ থাকতে পারে। এই নিবন্ধটি সেই সকল মায়েদের জন্য যারা তাদের আসন্ন সন্তানের জন্য সেরা যত্ন নিতে চান এবং একটি সুস্থ গর্ভাবস্থা কাটাতে চান। আমরা আশা করি এই তথ্যগুলো গর্ভবতী মায়েদের জন্য উপকারী হবে এবং তাদের একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে সাহায্য করবে।
গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায়ে যত্ন
গর্ভবতী মায়েদের সুস্থ সন্তান জন্মদানের পরামর্শ নিয়ে আজকের এই আলোচনা শুরু করতে চাই। গর্ভাবস্থা একটি নারীর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়, যখন তার শরীর ও মনের অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন হয়। প্রথম তিন মাস বা প্রথম ত্রৈমাসিক হলো গর্ভাবস্থার সবচেয়ে সংবেদনশীল সময়, কারণ এই সময়ে শিশুর সকল প্রধান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন হয়। এই সময়ে মা যা খাবেন, যা করবেন এবং যে পরিবেশে থাকবেন তা সরাসরি ভ্রূণের বিকাশকে প্রভাবিত করে।
তাই এই সময়ে মায়েদের অবশ্যই সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে, যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল এবং ফলিক এসিড থাকে। ফলিক এসিড শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক বিকাশে সাহায্য করে এবং নিউরাল টিউব ডিফেক্টের ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও প্রথম ত্রৈমাসিকে অনেক মায়েরা বমি বমি ভাব, অবসাদ এবং ক্লান্তি অনুভব করেন, যা স্বাভাবিক। এই সময়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া এবং ছোট ছোট খাবার খেতে থাকা উচিত। ধূমপান, মদ্যপান এবং কোনো ধরনের মাদকদ্রব্য এড়িয়ে চলতে হবে, কারণ এগুলো শিশুর বিকাশে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
এছাড়াও কিছু ওষুধ আছে যা গর্ভাবস্থায় সেবন করা নিরাপদ নয়, তাই কোনো ওষুধ খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব একজন অভিজ্ঞ গাইনোকোলজিস্টের কাছে যাওয়া উচিত এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চেকআপ করা উচিত। প্রথম পরিদর্শনে ডাক্তার সাধারণত গর্ভাবস্থার বয়স নির্ধারণ, মায়ের সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং কিছু প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
এই সময়ে মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে, কারণ মায়ের মানসিক অবস্থা সরাসরি ভ্রূণের ওপর প্রভাব ফেলে। পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে স্বামীর সহযোগিতা ও সমর্থন এই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ
গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ মায়ের খাদ্য থেকেই শিশু তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ভিটামিন এবং মিনারেল থাকতে হবে। প্রোটিন শিশুর কোষ ও টিস্যু গঠনে সাহায্য করে, তাই প্রতিদিন প্রায় ৭০-১০০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত। প্রোটিনের উৎস হিসেবে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, দই, পনির, ডাল, বিনস, বাদাম ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
কার্বোহাইড্রেট শরীরের জন্য শক্তির প্রধান উৎস, তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় জটিল কার্বোহাইড্রেট যেমন আলু, ভাত, রুটি, ওটস, ব্রাউন রাইস ইত্যাদি রাখা উচিত। স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যেমন ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড শিশুর মস্তিষ্ক ও চোখের বিকাশে সাহায্য করে। ওমেগা-৩ এর উৎস হিসেবে স্যামন, সার্ডিন, ম্যাকেরেল জাতীয় মাছ, কাঁচা বাদাম, চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্সসিড ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ভিটামিন ও মিনারেলের মধ্যে ফলিক এসিড, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি১২ ইত্যাদি গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলিক এসিড শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক বিকাশে সাহায্য করে এবং নিউরাল টিউব ডিফেক্টের ঝুঁকি কমায়।
ফলিক এসিডের উৎস হিসেবে সবুজ শাকসবজি যেমন পালং শাক, লেটুস, ব্রোকলি, ফুলকপি, লিভার, ডিমের কুসুম, শিম, মটরশুঁটি ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে। আয়রনের উৎস হিসেবে লাল মাংস, লিভার, ডিমের কুসুম, শুকনো ফল, শাকসবজি, ডাল, বাদাম ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ক্যালসিয়াম শিশুর হাড় ও দাঁতের বিকাশে সাহায্য করে। ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে দুধ, দই, পনির, ছানা, সয়াদুধ, টফু, সামুদ্রিক মাছ, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে। ভিটামিন ডি-এর উৎস হিসেবে সকালের সূর্যের আলো, দুধ, ডিমের কুসুম, মাছ, লিভার অয়েল ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরে আয়রন শোষণে সাহায্য করে। ভিটামিন সি-এর উৎস হিসেবে আমলকি, জাম, কমলালেবু, আনারস, পেঁপে, টমেটো, বাধাকপি, ফুলকপি ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ভিটামিন বি১২ স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ভিটামিন বি১২-এর উৎস হিসেবে মাংস, মাছ, ডিম, দুধ, দই, পনির ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা উচিত, কারণ পানি শরীরের তরল ভারসাম্য বজায় রাখে, কোষ্টকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং পুষ্টি উপাদানগুলোকে শিশুর কাছে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে।
আরো পড়ুনঃ সন্তানের ত্বকের রং ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয় কেন?
প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত। এছাড়াও ফলের রস, দুধ, দই, শরবত ইত্যাদিও পানির চাহিদা পূরণে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় কিছু খাবার এড়িয়ে চলা উচিত, যেমন কাঁচা বা আধা-সিদ্ধ মাংস ও ডিম, কাঁচা দুধ ও দুধজাত পণ্য, উচ্চ পারদযুক্ত মাছ যেমন শার্ক, সোর্ডফিশ, কিং ম্যাকেরেল ইত্যাদি, ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় যেমন কফি, চা, কোমল পানীয়, অ্যালকোহল, ধূমপান ইত্যাদি। এছাড়াও বাইরের খাবার, ফাস্টফুড, জাঙ্ক ফুড, অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার, মসলাদার খাবার এড়িয়ে চলা উচিত।
গর্ভাবস্থায় অনেক মায়েরা বিভিন্ন ধরনের খাদ্য অ্যালার্জি বা অনাক্রম্যতা অনুভব করতে পারেন, তাই নতুন কোনো খাবার খাওয়ার আগে সতর্ক থাকা উচিত। গর্ভাবস্থায় অনেক মায়েরা বমি বমি ভাব, অ্যাসিডিটি, কোষ্টকাঠিন্য, পেট ফাঁপা ইত্যাদি সমস্যা অনুভব করেন, তাই ছোট ছোট খাবার খেতে থাকা উচিত এবং ভারী খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। রাতে ঘুমানোর আগে ভারী খাবার খাওয়া উচিত নয়, কারণ এতে অ্যাসিডিটি ও বদহজমের সমস্যা হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক, তবে অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এতে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, প্রসবকালীন জটিলতা ইত্যাদির ঝুঁকি বেড়ে যায়। সাধারণত গর্ভাবস্থায় ১১-১৬ কেজি ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়, তবে এটি মায়ের আগের ওজন, উচ্চতা, বয়স ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। গর্ভাবস্থায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শে ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হতে পারে, বিশেষ করে ফলিক এসিড, আয়রন, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি। তবে কোনো সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম ও শারীরিক কর্মকাণ্ড
গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক কর্মকাণ্ড করা মা ও শিশু উভয়ের জন্যই উপকারী। ব্যায়াম গর্ভাবস্থায় সাধারণ অস্বস্তি যেমন কোমর ব্যথা, পেট ফাঁপা, কোষ্টকাঠিন্য, বমি বমি ভাব ইত্যাদি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও ব্যায়াম মায়ের মেজাজ উন্নত করে, শক্তি বাড়ায়, ঘুমের মান উন্নত করে এবং প্রসবকালীন ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায়। তবে গর্ভাবস্থায় সব ধরনের ব্যায়াম করা নিরাপদ নয়, তাই কোনো ব্যায়াম শুরু করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। সাধারণত হাঁটা, সাঁতার, যোগব্যায়াম, পাইলেটস, স্টেশনারি সাইকেলিং ইত্যাদি গর্ভাবস্থায় নিরাপদ ব্যায়াম হিসেবে বিবেচিত হয়।
হাঁটা গর্ভাবস্থার সবচেয়ে নিরাপদ ও সহজ ব্যায়াম, যা কোনো বিশেষ সরঞ্জাম ছাড়াই করা যায়। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা উচিত, তবে একসাথে অনেকক্ষণ না হেঁটে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে হাঁটা যেতে পারে। সাঁতার একটি দুর্দান্ত ব্যায়াম, কারণ পানিতে শরীরের ওজন কম অনুভূত হয়, যা জয়েন্টগুলোর উপর চাপ কমায়। যোগব্যায়াম নমনীয়তা, ভারসাম্য এবং শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। তবে গর্ভাবস্থায় কিছু যোগ আসন এড়িয়ে চলা উচিত, যেমন পেটের উপর চাপ পড়ে এমন আসন, পিঠের উপর শুয়ে করা আসন, উল্টো হয়ে করা আসন ইত্যাদি।
পাইলেটস কোর, পেলভিক ফ্লোর এবং পিঠের পেশীগুলোকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে, যা গর্ভাবস্থা ও প্রসবকালীন সময়ে উপকারী। স্টেশনারি সাইকেলিং হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে এবং পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়। গর্ভাবস্থায় কিছু ব্যায়াম এড়িয়ে চলা উচিত, যেমন উচ্চ প্রভাব ব্যায়াম (যেমন দৌড়ানো, লাফানো), যোগাযোগ ক্রীড়া (যেমন ফুটবল, বাস্কেটবল), স্কিইং, ঘোড়দৌড়, সাইকেল চালানো, জিমন্যাস্টিক ইত্যাদি। এছাড়াও পেটের উপর চাপ পড়ে এমন ব্যায়াম, পিঠের উপর শুয়ে করা ব্যায়াম, উল্টো হয়ে করা ব্যায়াম, গরমে করা ব্যায়াম ইত্যাদি এড়িয়ে চলা উচিত।
গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম করার সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, যেমন পর্যাপ্ত পানি পান করা, অতিরিক্ত গরমে ব্যায়াম না করা, ক্লান্ত বোধ করলে বিশ্রাম নেওয়া, শরীরের সংকেতগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া, আরামদায়ক পোশাক পরা ইত্যাদি। গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম করার সময় যদি কোনো সমস্যা হয়, যেমন যোনি থেকে রক্তপাত বা তরল নিঃসরণ, পেটে ব্যথা বা ক্র্যাম্প, মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট, পেটের নিচের দিকে চাপ অনুভব করা ইত্যাদি, তবে অবিলম্বে ব্যায়াম বন্ধ করে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
গর্ভাবস্থায় কেগেল ব্যায়াম করা অত্যন্ত উপকারী, কারণ এটি পেলভিক ফ্লোর পেশীগুলোকে শক্তিশালী করে, যা প্রসবকালীন সময়ে এবং প্রসবের পরে উপকারী। কেগেল ব্যায়াম করার জন্য প্রথমে পেলভিক ফ্লোর পেশীগুলো চিহ্নিত করতে হবে, যা প্রস্রাব বা মলত্যাগের সময় সাময়িকভাবে আটকে রাখার মাধ্যমে করা যায়। এরপর সেই পেশীগুলোকে ৫ সেকেন্ডের জন্য সঙ্কুচিত করে ধরে রাখতে হবে এবং তারপর আস্তে আস্তে ছেড়ে দিতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি দিনে অন্তত ৩ বার, প্রতিবার ১০-১৫ বার করা উচিত। গর্ভাবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করাও অত্যন্ত উপকারী, কারণ এটি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং প্রসবকালীন ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায়।
শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করার জন্য একটি আরামদায়ক স্থানে বসে নাক দিয়ে গভীরভাবে শ্বাস নিতে হবে, পেট ফুলিয়ে ধরে রাখতে হবে, তারপর মুখ দিয়ে আস্তে আস্তে শ্বাস ছাড়তে হবে। এই প্রক্রিয়াটি দিনে অন্তত ৫-১০ মিনিট করা উচিত। গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম করার সময় নিজের শরীরের সীমাবদ্ধতাগুলোকে মাথায় রাখা উচিত এবং কখনই অতিরিক্ত পরিশ্রম করা উচিত নয়। গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে ব্যায়াম করার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত, কারণ এই সময়ে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেশি থাকে।
গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাসেও ব্যায়াম করার সময় সতর্ক থাকতে হবে, কারণ এই সময়ে পেটের আকার বড় হওয়ায় ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে পড়ে এবং পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম করার সময় একজন অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে করা উচিত, বিশেষ করে যারা আগে কখনও ব্যায়াম করেননি বা যাদের গর্ভাবস্থায় কোনো জটিলতা আছে। গর্ভাবস্থায় ব্যায়াম করা মা ও শিশু উভয়ের জন্যই উপকারী, তবে সবসময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এবং সতর্কতার সাথে ব্যায়াম করা উচিত।
গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চিকিৎসা পরীক্ষা
গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চিকিৎসা পরীক্ষা মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব একজন অভিজ্ঞ গাইনোকোলজিস্টের কাছে যাওয়া উচিত এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত চেকআপ করা উচিত। সাধারণত গর্ভাবস্থার প্রথম ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি ৪ সপ্তাহ অন্তর, ২৮-৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি ২ সপ্তাহ অন্তর এবং ৩৬ সপ্তাহের পর প্রতি সপ্তাহে চেকআপ করা উচিত। তবে যদি কোনো জটিলতা থাকে, তবে ডাক্তার আরও ঘন ঘন চেকআপের পরামর্শ দিতে পারেন।
প্রথম পরিদর্শনে ডাক্তার সাধারণত গর্ভাবস্থার বয়স নির্ধারণ, মায়ের সাধারণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং কিছু প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষাগুলোর মধ্যে রক্তের গ্রুপ ও আরএইচ ফ্যাক্টর নির্ণয়, রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা পরীক্ষা, রক্তে চিনির মাত্রা পরীক্ষা, এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি, সিফিলিস ইত্যাদি সংক্রামক রোগের পরীক্ষা, থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট, ইউরিন টেস্ট ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এছাড়াও প্রথম পরিদর্শনে আল্ট্রাসাউন্ড করে গর্ভাবস্থার বয়স নির্ধারণ, ভ্রূণের হৃদস্পন্দন পরীক্ষা এবং গর্ভাশয়ের অবস্থা পরীক্ষা করা হয়।
গর্ভাবস্থার ১১-১৪ সপ্তাহে নিউকাল ট্রান্সলুসেন্সি পরীক্ষা করা হয়, যা ডাউন সিনড্রোম এবং অন্যান্য ক্রোমোজোমাল অ্যানোমালির ঝুঁকি নির্ধারণে সাহায্য করে। এই পরীক্ষার সাথে ডাবল মার্কার টেস্ট করা হতে পারে, যা আরও নিখুঁতভাবে ঝুঁকি নির্ধারণে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থার ১৮-২২ সপ্তাহে লেভেল ২ আল্ট্রাসাউন্ড বা অ্যানোমালি স্ক্যান করা হয়, যার মাধ্যমে ভ্রূণের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন পরীক্ষা করা হয় এবং কোনো শারীরিক অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তা নির্ধারণ করা হয়। এই সময়ে ভ্রূণের লিঙ্গও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। গর্ভাবস্থার ২৪-২৮ সপ্তাহে গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (জিটিটি) করা হয়, যার মাধ্যমে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের উপস্থিতি নির্ধারণ করা হয়।
এই পরীক্ষায় প্রথমে রক্তে চিনির মাত্রা পরীক্ষা করা হয়, তারপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্লুকোজ পান করানো হয় এবং ২ ঘণ্টা পর আবার রক্তে চিনির মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। যদি রক্তে চিনির মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, তবে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়তে পারে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম এবং প্রয়োজনে ইনসুলিন নিতে হয়। গর্ভাবস্থার ২৮-৩২ সপ্তাহে আরেকটি আল্ট্রাসাউন্ড করা হতে পারে, যার মাধ্যমে ভ্রূণের বৃদ্ধি, অবস্থান এবং অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইডের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও এই সময়ে ডপলার আল্ট্রাসাউন্ড করা হতে পারে, যার মাধ্যমে ভ্রূণের রক্ত সরবরাহ পরীক্ষা করা হয়।
আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় বার বার হাঁচি আসলে গর্ভের সন্তানের জন্য কতটা ঝুঁকি?
গর্ভাবস্থার ৩৬ সপ্তাহের পর প্রতি সপ্তাহে চেকআপের সময় ভ্রূণের হৃদস্পন্দন পরীক্ষা, মায়ের রক্তচাপ পরীক্ষা, পেটের আকার পরিমাপ করা হয় এবং ভ্রূণের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। এছাড়াও প্রয়োজনে পেলভিক এক্সামিনেশন করা হতে পারে, যার মাধ্যমে প্রসবের জন্য পেলভিসের উপযুক্ততা নির্ধারণ করা হয়। গর্ভাবস্থায় কিছু বিশেষ পরীক্ষা কেবলমাত্র প্রয়োজনের সময় করা হয়, যেমন অ্যামনিওসেন্টেসিস, কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং (সিভিএস), কর্ডিওসেন্টেসিস ইত্যাদি। এই পরীক্ষাগুলো সাধারণত ক্রোমোজোমাল অ্যানোমালি বা জেনেটিক ডিসঅর্ডার নির্ণয়ের জন্য করা হয়, যদি আগের পরীক্ষাগুলোতে কোনো ঝুঁকি পাওয়া যায়।
এই পরীক্ষাগুলো আক্রমণাত্মক পদ্ধতি, তাই এগুলো করার আগে ডাক্তারের সাথে সম্পূর্ণ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত, কারণ উচ্চ রক্তচাপ বা প্রি-এক্লাম্পসিয়া গর্ভাবস্থায় একটি গুরুতর জটিলতা হতে পারে, যা মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রি-এক্লাম্পসিয়ার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, প্রস্রাবে প্রোটিন, হাত ও পায়ে ফোলা, মাথাব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি, পেটে ব্যথা ইত্যাদি। যদি এই লক্ষণগুলো দেখা যায়, তবে অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
গর্ভাবস্থায় রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত, কারণ রক্তস্বল্পতা গর্ভাবস্থায় একটি সাধারণ সমস্যা, যা মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। রক্তস্বল্পতার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্বলতা, ক্লান্তি, ফ্যাকাশে ত্বক, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা ইত্যাদি। রক্তস্বল্পতা ধরা পড়লে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা উচিত এবং আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চিকিৎসা পরীক্ষা করা মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই কোনো চেকআপ মিস করা উচিত নয়। এছাড়াও কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
গর্ভাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা
গর্ভাবতী মায়েদের সুস্থ সন্তান জন্মদানের পরামর্শের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনে একটি বড় পরিবর্তন, যা শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও প্রভাব ফেলে। এই সময়ে অনেক মায়েরা উদ্বেগ, উত্তেজনা, ভয়, অবসাদ ইত্যাদি অনুভব করতে পারেন, যা স্বাভাবিক। তবে যদি এই অনুভূতিগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে, তবে তা গর্ভবতী মায়েদের সুস্থ সন্তান জন্মদানের পরামর্শ মেনে চলতে বাধা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় মানসিক চাপ মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ শিশুর বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে এবং প্রিম্যাচিউর বার্থ, লো বার্থ ওয়েট, বিহেভিয়ারাল প্রবলেম ইত্যাদির ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন নিজের অনুভূতিগুলোকে স্বীকার করা এবং সেগুলো নিয়ে কথা বলা। স্বামী, পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব বা একজন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সাথে কথা বললে মানসিক চাপ কমতে পারে। এছাড়াও নিয়মিত ব্যায়াম, যোগব্যায়াম, ধ্যান, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম ইত্যাদি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া এবং ঘুমানোও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় অনেক মায়েরা ঘুমের সমস্যায় ভোগেন, তাই ঘুমানোর আগে একটি নির্দিষ্ট রুটিন অনুসরণ করা, আরামদায়ক পরিবেশে ঘুমানো, ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা, দিনের বেলায় ঘুমানো এড়িয়ে চলা ইত্যাদি উপকারী হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সামাজিক সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে স্বামীর সহযোগিতা ও সমর্থন এই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী মায়ের সাথে গর্ভাবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারেন, তার অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দিতে পারেন, তাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতে পারেন এবং তার সাথে ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন।
এছাড়াও অন্যান্য পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব এবং সমাজের মানুষের সমর্থনও গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় অনেক মায়েরা নিজেদের আলাদা বোধ করতে পারেন, তাই অন্য গর্ভবতী মায়েদের সাথে যোগাযোগ করা, গর্ভাবস্থা বিষয়ক গ্রুপে যোগ দেওয়া ইত্যাদি উপকারী হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নিজের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজের পছন্দের কাজ করা, যেমন পড়া, সঙ্গীত শোনা, ছবি আঁকা, বাগান করা ইত্যাদি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও নিয়মিত ম্যাসেজ, স্পা, আরামদায়ক গোসল ইত্যাদিও মানসিক শান্তি আনতে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক চিন্তাভাবনা গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভাবস্থা একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা, যা একজন নারীকে মা হওয়ার সুযোগ দেয়। তাই গর্ভাবস্থাকে ইতিবাচকভাবে দেখা, ভ্রূণের সাথে কথা বলা, ভ্রূণের জন্য ভালোবাসা অনুভব করা ইত্যাদি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। গর্ভাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য পেশাদার সাহায্য নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। যদি মানসিক চাপ, উদ্বেগ, অবসাদ ইত্যাদি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে, তবে একজন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সাথে কথা বলা উচিত। গর্ভাবস্থায় অনেক মায়েরা প্রি-নেটাল ডিপ্রেশনে ভোগেন, যা চিকিৎসা ছাড়া কাটতে পারে না।
প্রি-নেটাল ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী দুঃখিত অনুভূতি, আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, ঘুমের সমস্যা, ক্ষুধার সমস্যা, অপরাধবোধ, অমূল্য অনুভূতি, মৃত্যুর কথা চিন্তা করা ইত্যাদি। যদি এই লক্ষণগুলো দেখা যায়, তবে অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। গর্ভাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সুষম খাদ্য গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কিছু খাদ্য উপাদান মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, যেমন ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন বি, ভিটামিন ডি, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের উৎস হিসেবে স্যামন, সার্ডিন, ম্যাকেরেল জাতীয় মাছ, কাঁচা বাদাম, চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্সসিড ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
আরো পড়ুনঃ ভ্রূণের মৃত্যু হলে কতক্ষণে শারীরিক পরিবর্তন ঘটে
ভিটামিন বি-এর উৎস হিসেবে সবুজ শাকসবজি, ডিম, দুধ, দই, পনির, মাংস, মাছ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ভিটামিন ডি-এর উৎস হিসেবে সকালের সূর্যের আলো, দুধ, ডিমের কুসুম, মাছ, লিভার অয়েল ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ম্যাগনেসিয়ামের উৎস হিসেবে সবুজ শাকসবজি, বাদাম, বীজ, শস্যদানা, কলা, অ্যাভোকাডো ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। গর্ভাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্যাফেইন, অ্যালকোহল, ধূমপান ইত্যাদি এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। গর্ভাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া মা ও শিশু উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাই গর্ভাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখা উচিত এবং প্রয়োজনে পেশাদার সাহায্য নেওয়া উচিত।
প্রসবের প্রস্তুতি
প্রসবের প্রস্তুতি গর্ভাবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মা ও শিশু উভয়ের জন্যই প্রয়োজন। প্রসব একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, তবে সঠিক প্রস্তুতি ছাড়া এটি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। প্রসবের প্রস্তুতি শুরু করা উচিত গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিক থেকে, তবে কিছু প্রস্তুতি আগে থেকেই শুরু করা যেতে পারে। প্রসবের প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছে শারীরিক প্রস্তুতি, মানসিক প্রস্তুতি, আর্থিক প্রস্তুতি, হাসপাতালের ব্যাগ প্রস্তুত করা, শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা ইত্যাদি। শারীরিক প্রস্তুতির জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কেগেল ব্যায়াম, পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম, স্কোয়াট, ওয়াকিং ইত্যাদি প্রসবকালীন সময়ে উপকারী হতে পারে।
কেগেল ব্যায়াম পেলভিক ফ্লোর পেশীগুলোকে শক্তিশালী করে, যা প্রসবকালীন সময়ে এবং প্রসবের পরে উপকারী। পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম পেলভিক এরিয়ার পেশীগুলোকে শক্তিশালী করে, যা প্রসবকালীন সময়ে উপকারী। স্কোয়াট হিপ এবং পেলভিক এরিয়ার পেশীগুলোকে শক্তিশালী করে, যা প্রসবকালীন সময়ে উপকারী। ওয়াকিং হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে এবং প্রসবকালীন ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায়। মানসিক প্রস্তুতির জন্য প্রসব সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসবের বিভিন্ন স্টেজ, প্রসবের সময় কী কী হতে পারে, প্রসবের ব্যথা কমানোর উপায়, প্রসবের সময় কী কী করা উচিত এবং কী কী করা উচিত নয় ইত্যাদি সম্পর্কে জানা উচিত।
এছাড়াও প্রসব সম্পর্কে ভিডিও দেখা, বই পড়া, অন্য মায়েদের অভিজ্ঞতা শোনা, প্রসব বিষয়ক ক্লাসে যোগ দেওয়া ইত্যাদিও মানসিক প্রস্তুতির জন্য উপকারী। প্রসবের সময় ব্যথা সহ্য করার জন্য বিভিন্ন কৌশল শেখা উচিত, যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, ধ্যান, ম্যাসেজ, হাইপনোবার্থ, ওয়াটার বার্থ ইত্যাদি। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম প্রসবকালীন ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং মানসিক চাপ কমায়। ধ্যান মানসিক শান্তি আনে এবং প্রসবকালীন ব্যথা সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ায়। ম্যাসেজ পেশীতে ব্যথা কমায় এবং মানসিক শান্তি আনে। হাইপনোবার্থ হলো একটি কৌশল, যার মাধ্যমে হিপনোসিস ব্যবহার করে প্রসবকালীন ব্যথা কমানো হয়।
ওয়াটার বার্থ হলো পানিতে প্রসব করা, যা প্রসবকালীন ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। আর্থিক প্রস্তুতির জন্য প্রসব এবং প্রসবের পরের খরচ নিয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা করা উচিত। হাসপাতালের ফি, ডাক্তারের ফি, মেডিসিনের খরচ, টেস্টের খরচ, শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের খরচ ইত্যাদি আগে থেকেই হিসাব করে রাখা উচিত। এছাড়াও বীমা কভারেজ সম্পর্কে জানা উচিত এবং প্রয়োজনে বীমা করা উচিত। হাসপাতালের ব্যাগ প্রস্তুত করা প্রসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
হাসপাতালের ব্যাগে কী কী রাখা উচিত তা আগে থেকেই তালিকা করে রাখা উচিত। সাধারণত হাসপাতালের ব্যাগে রাখা উচিত মায়ের জন্য আরামদায়ক পোশাক, আন্ডারগারমেন্টস, স্লিপার, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, টোয়েল, প্যাড, ব্রা, নার্সিং প্যাড, লিপবাম, মোবাইল ফোন, চার্জার, ক্যামেরা, বই, ম্যাগাজিন, স্ন্যাকস, ওয়াটার বোতল ইত্যাদি। শিশুর জন্য রাখা উচিত নবজাতকের পোশাক, ডায়াপার, ওয়াইপস, ব্ল্যাঙ্কেট, ক্যাপ, মোজা, টয়লেট্রি প্রোডাক্ট ইত্যাদি।
স্বামী বা সঙ্গীর জন্য রাখা উচিত অতিরিক্ত পোশাক, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান, শ্যাম্পু, টোয়েল, স্ন্যাকস, ওয়াটার বোতল, মোবাইল ফোন, চার্জার, ক্যামেরা ইত্যাদি। হাসপাতালের ব্যাগ গর্ভাবস্থার ৩৬ সপ্তাহের মধ্যে প্রস্তুত করে রাখা উচিত, কারণ যেকোনো সময় প্রসব হতে পারে। শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা প্রসবের আগেই শেষ করা উচিত। শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মধ্যে রয়েছে ক্রিব, ম্যাট্রেস, বেডিং, স্ট্রোলার, কার সিট, ডায়াপার, ওয়াইপস, বেবি লোশন, বেবি অয়েল, বেবি পাউডার, বেবি শ্যাম্পু, বেবি সাবান, বেবি টুথব্রাশ, বেবি টুথপেস্ট, বেবি নেইল ক্লিপার, বেবি থার্মোমিটার, বেবি মনিটর, বেবি ক্যারিয়ার, বেবি সুইং, বেবি প্লেপেন, বেবি টয়স ইত্যাদি।
এছাড়াও শিশুর জন্য পোশাক, ক্যাপ, মোজা, হ্যান্ডকারচিফ, বালিশ, কম্বল ইত্যাদিও কেনা উচিত। প্রসবের প্রস্তুতির জন্য প্রসব পরিকল্পনা করা উচিত। প্রসব পরিকল্পনায় কোথায় প্রসব করতে চান, কার উপস্থিতিতে প্রসব করতে চান, প্রসবের সময় কী কী করতে চান এবং কী কী করতে চান না, প্রসবের পরে শিশুর যত্ন কে নেবে ইত্যাদি উল্লেখ করা উচিত। প্রসব পরিকল্পনা ডাক্তার এবং হাসপাতালের সাথে আলোচনা করে তৈরি করা উচিত।
আরো পড়ুনঃ সিজারের পর মায়ের করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন
প্রসবের প্রস্তুতির জন্য প্রসবের লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানা উচিত। প্রসবের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে নিয়মিত কনট্রাকশন, পেটে ব্যথা, পিঠে ব্যথা, পেটের নিচের দিকে চাপ অনুভব করা, যোনি থেকে রক্তপাত বা তরল নিঃসরণ, ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব ইত্যাদি। যদি এই লক্ষণগুলো দেখা যায়, তবে অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। প্রসবের প্রস্তুতি গর্ভাবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মা ও শিশু উভয়ের জন্যই প্রয়োজন। তাই প্রসবের আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করা উচিত এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে।
ক্ষতিকারক পদার্থ থেকে দূরে থাকা
গর্ভাবস্থা এমন একটি সময় যখন একজন মায়ের জীবনধারা সরাসরি তার গর্ভে বর্ধমান শিশুর উপর প্রভাব ফেলে। এই সময় কিছু ক্ষতিকারক পদার্থ থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো শিশুর বিকাশকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ধূমপান গর্ভাবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিকারক অভ্যাসের মধ্যে একটি। ধূমপানের ফলে শিশুর ওজন কম হতে পারে, অকাল প্রসবের ঝুঁকি বাড়তে পারে, শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে, এমনকি সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম (এসআইডিএস) এর ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
ধূমপানের ফলে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশও প্রভাবিত হতে পারে, যার ফলে শিশুর শেখার ক্ষমতা এবং আচরণে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় ধূমপান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা উচিত। এছাড়াও, অন্যের ধোঁয়া থেকেও দূরে থাকা উচিত, কারণ প্যাসিভ স্মোকিংও শিশুর জন্য ক্ষতিকারক। অ্যালকোহল গর্ভাবস্থায় আরেকটি ক্ষতিকারক পদার্থ। অ্যালকোহল গর্ভবতী মায়ের রক্তের মাধ্যমে ভ্রূণে পৌঁছায় এবং শিশুর বিকাশকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।
অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে শিশুর ফিটাল অ্যালকোহল স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার (এফএএসডি) হতে পারে, যার ফলে শিশুর মুখের গঠনে সমস্যা, বুদ্ধিমত্তার ঘাটতি, আচরণগত সমস্যা, শেখার সমস্যা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে শিশুর ওজন কম হতে পারে, অকাল প্রসবের ঝুঁকি বাড়তে পারে, এমনকি গর্ভপাতের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলা উচিত। মাদকদ্রব্য গর্ভাবস্থায় আরেকটি ক্ষতিকারক পদার্থ।
মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে শিশুর বিকাশ মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে শিশুর ওজন কম হতে পারে, অকাল প্রসবের ঝুঁকি বাড়তে পারে, শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ প্রভাবিত হতে পারে, এমনকি শিশুর মৃত্যুও হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় মাদকদ্রব্য সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলা উচিত। ক্যাফেইন গর্ভাবস্থায় আরেকটি পদার্থ যা সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। ক্যাফেইন কফি, চা, কোমল পানীয়, চকলেট, কিছু ওষুধ ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণের ফলে শিশুর ওজন কম হতে পারে, অকাল প্রসবের ঝুঁকি বাড়তে পারে, এমনকি গর্ভপাতের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় ক্যাফেইন গ্রহণ সীমিত করা উচিত।
সাধারণত দিনে ২০০ মিলিগ্রামের বেশি ক্যাফেইন গ্রহণ করা উচিত নয়, যা প্রায় ২ কাপ কফি বা ৪ কাপ চায়ের সমতুল্য। কিছু ওষুধ গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকারক হতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় কোনো ওষুধ গ্রহণের আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত। বিশেষ করে ব্যথানাশক ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টিকনভালসেন্ট ইত্যাদি ওষুধ গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকারক হতে পারে। তাই এই ওষুধগুলো গ্রহণের আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত। কিছু রাসায়নিক পদার্থ গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকারক হতে পারে।
যেমন কীটনাশক, পেইন্ট, সলভেন্ট, পারফিউম, কিছু পরিষ্কারক পদার্থ ইত্যাদি। এই পদার্থগুলো থেকে দূরে থাকা উচিত। কিছু খাবার গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকারক হতে পারে। যেমন কাঁচা বা অসিদ্ধ মাংস, কাঁচা বা অসিদ্ধ ডিম, কাঁচা দুধ, নরম পনির, কিছু মাছ যেমন শার্ক, সোর্ডফিশ, কিং ম্যাকেরেল যাতে পারদের মাত্রা বেশি থাকে।
এই খাবারগুলো থেকে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা পরজীবী সংক্রমণের ঝুঁকি থাকতে পারে, যা শিশুর জন্য ক্ষতিকারক। তাই গর্ভাবস্থায় এই খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। গর্ভাবস্থায় ক্ষতিকারক পদার্থ থেকে দূরে থাকা একটি সুস্থ গর্ভাবস্থা এবং সন্তান জন্মদানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিটি গর্ভবতী মায়ের উচিত এই ক্ষতিকারক পদার্থগুলো থেকে দূরে থাকা এবং একটি সুস্থ জীবনধারা অবলম্বন করা।
প্রসবোত্তর যত্ন
প্রসবোত্তর যত্ন গর্ভবতী মায়েদের সুস্থ সন্তান জন্মদানের পরামর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কারণ প্রসবের পরে মায়ের শরীর এবং মন উভয়ই দুর্বল থাকে এবং সঠিক যত্নের প্রয়োজন হয়। প্রসবোত্তর সময়টি সাধারণত ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত হয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি সময় ধরে চলতে পারে। প্রসবোত্তর যত্নের মধ্যে রয়েছে শারীরিক যত্ন, মানসিক যত্ন, পুষ্টি, বিশ্রাম, ব্যায়াম, স্তন্যপান ইত্যাদি। প্রসবোত্তর শারীরিক যত্নের মধ্যে রয়েছে ক্ষত স্থানের যত্ন, ব্যথা ব্যবস্থাপনা, রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ, কোষ্টকাঠিন্য প্রতিরোধ, সংক্রমণ প্রতিরোধ ইত্যাদি।
প্রসবের পরে যোনি বা সিজারিয়ান ক্ষত স্থানের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যোনি প্রসবের পরে যোনি এলাকা পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখা উচিত এবং নিয়মিত প্যাড পরিবর্তন করা উচিত। সিজারিয়ান প্রসবের পরে ক্ষত স্থান পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখা উচিত এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ব্যবহার করা উচিত। প্রসবের পরে পেটে ব্যথা, ক্র্যাম্প, পিঠে ব্যথা ইত্যাদি অনুভব করা স্বাভাবিক, তবে ব্যথা বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার করা উচিত।
আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় তেঁতুল খাওয়া যাবে কিনা এবং গর্ভাবস্থায় তেতুল খেলে কি ক্ষতি হয়
প্রসবের পরে রক্তপাত স্বাভাবিক, তবে রক্তপাত বেশি হলে বা রক্তে বড় বড় জমাট বাঁধলে অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। প্রসবের পরে কোষ্টকাঠিন্য একটি সাধারণ সমস্যা, তাই পর্যাপ্ত পানি পান করা, আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা ইত্যাদি কোষ্টকাঠিন্য প্রতিরোধে সাহায্য করে। প্রসবের পরে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে, তাই ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, ক্ষত স্থান পরিষ্কার রাখা, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা ইত্যাদি সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে। প্রসবোত্তর মানসিক যত্নের মধ্যে রয়েছে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন প্রতিরোধ ও চিকিৎসা, মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা, পরিবারের সমর্থন ইত্যাদি।
প্রসবের পরে অনেক মায়েরা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভোগেন, যা চিকিৎসা ছাড়া কাটতে পারে না। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী দুঃখিত অনুভূতি, আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, ঘুমের সমস্যা, ক্ষুধার সমস্যা, অপরাধবোধ, অমূল্য অনুভূতি, শিশুর প্রতি আগ্রহহীনতা, মৃত্যুর কথা চিন্তা করা ইত্যাদি। যদি এই লক্ষণগুলো দেখা যায়, তবে অবিলম্বে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। প্রসবের পরে মানসিক চাপ বাড়তে পারে, তাই নিয়মিত বিশ্রাম নেওয়া, পর্যাপ্ত ঘুমানো, নিজের পছন্দের কাজ করা, পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটানো ইত্যাদি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। প্রসবোত্তর পুষ্টির জন্য সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রসবের পরে মায়ের শরীরে পুষ্টির চাহিদা বেড়ে যায়, বিশেষ করে যারা স্তন্যপান করান। প্রসবোত্তর খাদ্য তালিকায় অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ভিটামিন এবং মিনারেল থাকতে হবে। প্রোটিন শরীরের ক্ষত সারাতে সাহায্য করে এবং স্তন্যপান করানো মায়েদের দুধের উৎপাদন বাড়ায়। প্রোটিনের উৎস হিসেবে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, দই, পনির, ডাল, বিনস, বাদাম ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। কার্বোহাইড্রেট শরীরের জন্য শক্তির প্রধান উৎস, তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় জটিল কার্বোহাইড্রেট যেমন আলু, ভাত, রুটি, ওটস, ব্রাউন রাইস ইত্যাদি রাখা উচিত। স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যেমন ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে এবং স্তন্যপান করানো মায়েদের দুধের গুণমান উন্নত করে।
ওমেগা-৩ এর উৎস হিসেবে স্যামন, সার্ডিন, ম্যাকেরেল জাতীয় মাছ, কাঁচা বাদাম, চিয়া সিড, ফ্ল্যাক্সসিড ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ভিটামিন ও মিনারেলের মধ্যে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন ডি, ভিটামিন বি১২, ফলিক এসিড ইত্যাদি প্রসবোত্তর সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে এবং স্তন্যপান করানো মায়েদের দুধের উৎপাদন বাড়ায়। ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে দুধ, দই, পনির, ছানা, সয়াদুধ, টফু, সামুদ্রিক মাছ, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং প্রসবোত্তর রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ করে। আয়রনের উৎস হিসেবে লাল মাংস, লিভার, ডিমের কুসুম, শুকনো ফল, শাকসবজি, ডাল, বাদাম ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে। ভিটামিন ডি-এর উৎস হিসেবে সকালের সূর্যের আলো, দুধ, ডিমের কুসুম, মাছ, লিভার অয়েল ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ভিটামিন বি১২ স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ভিটামিন বি১২-এর উৎস হিসেবে মাংস, মাছ, ডিম, দুধ, দই, পনির ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ফলিক এসিড রক্ত কোষ তৈরিতে সাহায্য করে।
ফলিক এসিডের উৎস হিসেবে সবুজ শাকসবজি যেমন পালং শাক, লেটুস, ব্রোকলি, ফুলকপি, লিভার, ডিমের কুসুম, শিম, মটরশুঁটি ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। প্রসবোত্তর সময়ে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা উচিত, কারণ পানি শরীরের তরল ভারসাম্য বজায় রাখে, কোষ্টকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং স্তন্যপান করানো মায়েদের দুধের উৎপাদন বাড়ায়। প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত। এছাড়াও ফলের রস, দুধ, দই, শরবত ইত্যাদিও পানির চাহিদা পূরণে সাহায্য করে। প্রসবোত্তর বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রসবের পরে মায়ের শরীর দুর্বল থাকে এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। প্রসবের পরে অন্তত ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া উচিত।
এই সময়ে ভারী কাজ এড়িয়ে চলা উচিত এবং পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নেওয়া উচিত। প্রসবোত্তর ব্যায়াম ধীরে ধীরে শুরু করা উচিত। প্রসবের পরে প্রথম কয়েক সপ্তাহ হাঁটা, হালকা ব্যায়াম ইত্যাদি করা যেতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে কেগেল ব্যায়াম, পেলভিক ফ্লোর ব্যায়াম, পেটের ব্যায়াম ইত্যাদি শুরু করা যেতে পারে। তবে কোনো ব্যায়াম শুরু করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রসবোত্তর স্তন্যপান শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মায়ের দুধে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান থাকে। স্তন্যপান করানো মায়েদের অতিরিক্ত পুষ্টির প্রয়োজন হয়, তাই সুষম খাদ্য গ্রহণ করা উচিত
আরো পড়ুনঃ গর্ভাবস্থায় শিশুর হার্টবিট আসার লক্ষণ ও তা বুঝতে করণীয়
এছাড়াও স্তন্যপান করানো মায়েদের পর্যাপ্ত পানি পান করা উচিত, কারণ পানি দুধের উৎপাদন বাড়ায়। স্তন্যপান করানোর সময় সঠিক অবস্থানে বসা উচিত এবং শিশুকে সঠিকভাবে স্তনে লাগানো উচিত। স্তন্যপান করানোর সময় কোনো সমস্যা হলে অবিলম্বে ডাক্তার বা ল্যাকটেশন কনসালট্যান্টের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। প্রসবোত্তর যত্ন গর্ভবতী মায়েদের সুস্থ সন্তান জন্মদানের পরামর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তাই প্রসবের পরে মায়ের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসবের পরে নিয়মিত চেকআপ করা উচিত এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে।
ইভিনিং বিডিতে কমেন্ট করুন
comment url